ফজরের নামাজ বরকত

ফজরের নামাজ হলো মানবজীবনের বরকতের অন্যতম উৎস। যা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও করুণা নিয়ে দিন শুরু করতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে সারাদিন দেহ-মন সজীব-সতেজ থাকে। এতে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের (ফজরের ও আসরের নামাজ) আগে নামাজ আদায় করবে সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। সহিহ মুসলিম : ৬৩৪

virtue of fajr prayer

ইসলামে যথাসময়ে ফজরের নামাজ আদায়ের অনেকগুলো সুফল বর্ণনা করেছেন। এর অন্যতম হলো

আল্লাহর সান্নিধ্যে দিনের শুরু : 

ফজরের নামাজ মুমিনদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সূর্যের আলো যেমন রাতের অন্ধকার দূর করে পৃথিবীকে আলোকিত করে। একইভাবে ফজরের নামাজ মুমিনদের আলো ও দিকনির্দেশনা দেয়। যার ফলে তাদের অন্তর আধ্যাত্মিক শক্তিতে আলোকিত হয়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, যে ফজরের নামাজ আদায় করল সে আল্লাহর পক্ষ থেকে জামানত লাভ করল। অতএব হে আদম সন্তান! লক্ষ রেখো আল্লাহ যেন অবশ্যই তোমাদের কাছে তার জামানতের কিছু দাবি না করেন। সহিহ মুসলিম : ৬৫৭

সুন্নত : 

ফজরের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত পালন করতে পারি। এই দুই রাকাত নামাজের মূল্য এত বেশি যে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ফজরের দুই রাকাত (সুন্নত) পৃথিবী ও তাতে যা কিছু আছে সবার চেয়ে উত্তম। সহিহ মুসলিম : ২৫

সুন্নাহভিত্তিক জীবন ব্যবস্থায় মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত। নবী করিম (সা.)-এর সুন্নত হলো তাড়াতাড়ি ঘুমানো ও ভোরে ঘুম থেকে ওঠা।

ফেরেশতাদের উপস্থিতি : 

আল্লাহতায়ালা বলেন, সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত নামাজ কায়েম করো। আর ফজরের নামাজ, নিশ্চয়ই ফজরের নামাজ উপস্থিতির সময়। সুরা বনি ইসরাইল : ৭৮

হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, ফজরের নামাজের সময় দিবারাত্রির উভয় দল ফেরেশতা উপস্থিত থাকে এবং খুব মনোযোগের সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াত শোনে। এই জন্য ফজরের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক বেশি। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের কাছে দিন ও রাত্রির ফেরেশতা পালাক্রমে যাতায়াত করতে থাকে। আর ফজর ও আসরের নামাজে তারা একত্র হয়। তারপর যারা তোমাদের কাছে রাত কাটিয়েছে তারা ঊর্ধ্বাকাশে চলে যায়। অতঃপর আল্লাহ তাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমরা আমার বান্দাদের কী অবস্থায় ছেড়ে এসেছ? তারা বলে, আমরা যখন তাদের ছেড়ে এসেছি তখন তারা নামাজে মশগুল ছিল। আর যখন আমরা তাদের কাছে গিয়েছিলাম তখনো তারা নামাজে ছিল। সহিহ মুসলিম : ৬৩২

মুমিন ও মুনাফিকের পার্থক্য : 

পরিপূর্ণ মুমিনের পথ পরিক্রমা ত্যাগ-তিতিক্ষার। আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিতে মুমিন ভোরের আরামের ঘুম বিসর্জন দেয় অবলীলায়। কারণ সে জানে, ঘুম থেকে নামাজ উত্তম। অন্যদিকে, মুনাফিকের ওপর ফজর ও এশার নামাজ অপেক্ষা অধিক ভারী নামাজ আর নেই। যদি তারা এর ফজিলত ও গুরুত্ব জানত তাহলে হামাগুঁড়ি দিয়ে হলেও মসজিদে উপস্থিত হতো। সহিহ মুসলিম : ৬৫১

ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায়ের গুরুত্ব বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি জামাতের সঙ্গে এশার নামাজ আদায় করল সে যেন অর্ধরাত্রি ইবাদত করল আর যে ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করল সে যেন সারারাত নামাজ পড়ল। সহিহ মুসলিম : ৬৫৬

বরকতময় ফজর :

ফজরের সময়টা খুব সুন্দর এবং বরকতময়। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের জন্য ভোরের সময়টাকে বরকতময় করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। তিনি যুদ্ধযাত্রা থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ ফজরের সময় করতেন। এছাড়া সময়মতো নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আমরা সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা পাই। সারা দিনের বাকি নামাজগুলো একটা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আদায় করার অনুপ্রেরণা পাই। এতে করে সারা দিনের সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। পর্যাপ্ত সময় পাওয়ায় ধীরেসুস্থে দিনের বাকি কাজ করা যায়।

আত্মার পরিশুদ্ধি  : 

ফজরের সময়টা সর্বোত্তম সময় আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতাময়। সময়মতো নামাজ আদায়ের মাধ্যমে নফসকে আমরা পরাজিত করি। সকাল বেলার সূর্য যেমন সব অন্ধকার দূর করে দেয়, তেমনি ফজরের নামাজ আদায় মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে নফসের শিকল থেকে। ফজরের নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আমরা নিজেদের অলসতা ও অসচেতনতা এবং অবসন্নতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি। কারণ তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পেছনের অংশে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে সে এই বলে চাপড়ায় তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত। অতএব তুমি শুয়ে থাকো। এরপর সে জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করলে একটি গিঁট খুলে যায়। পরে অজু করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। এরপর নামাজ আদায় করলে বাকিটিও খুলে যায়। তখন তার সকাল হয় উৎফুল্ল মনে ও অনাবিল চিত্তে। অন্যথায় সে সকালে উঠে কলুষ কালিমা ও আলস্য নিয়ে। সহিহ বোখারি : ১১৪২

বিশ্ব নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। এ অবস্থায় সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে থাকা সহজ নয়। কিন্তু যারা নফসের সঙ্গে লড়াই করে প্রতিনিয়ত নিজের ইমান ও আমল হেফাজতের চেষ্টায় রত তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অফুরন্ত পুরস্কার বরাদ্দ। আঁধারের কালো তাদের ছুঁতে পারে না। মুমিনদের সঠিক পথে রাখার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের এই নির্দেশনা। যার মাধ্যমে তারা রবের কাছে নিজেকে সঁপে দেয় নামাজের প্রতি ওয়াক্তে। আর ফজরের নামাজ আদায়ের মাধ্যমে দিনের শুরু মুমিনদের আত্মিক প্রশান্তিতে ভরিয়ে রাখে।

দিনের প্রথম নামাজ ফজর আদায়ের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত লাভ করি, যা ভোরের সময়টাতেই শুধু পাওয়া যায়। এই নামাজ মানুষকে বিবেকের উদাসীনতা ও অসচেতনতা থেকে রক্ষা করে। মুমিনদের আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভে সাহায্য করে।

ফজরের নামাজের ফজিলত

প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাজেরই আল্লাহ তায়ালা বিশেষ কিছু ফজিলত দান করেন। এর মধ্যে অন্যতম ফজরের নামাজ।  

নামাজ কায়েম করো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং কায়েম করো ফজরের নামাজ। নিশ্চয়ই ফজরের নামাজ উপস্থিতির সময়। (সূরা: বনি ইসরাঈল, আয়াত: ৭৮ (দ্বিতীয় পর্ব)।

ফজরের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব, তেমনি সময়ের মধ্যে ফজরের সময়ের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। পবিত্র কোরআনে ফজর নামে একটি সূরাও রয়েছে। ওই সূরার শুরুতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, শপথ ফজরের। (সূরা: ফজর, আয়াত : ১)
জুনদুব ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন,
যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ পড়বে, সে আল্লাহর জিম্মায় থাকবে। (মুসলিম, হাদিস : ৬৫৭)
 
অন্য হাদিসে ফজরের নামাজ আদায়কারীকে জান্নাতি মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবু মুসা আশয়ারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন,
যে ব্যক্তি দুটি শীতল সময়ে নামাজ আদায় করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (বুখারি ও মুসলিম)

 

ফজরের নামাজের ১০ পুরস্কার

ফজরের নামাজ পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম একটি। অন্য চার ওয়াক্তের চেয়ে ফজরের নামাজ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ফজর নামাজ আদায় করলে বহু সওয়াব ও পুরস্কারের কথা হাদিসে উল্লেখ হয়েছে। নিম্নে ফজরের নামাজ পড়ার ১০ টি পুরস্কার রয়েছে-

১ ) আল্লাহর নিরাপত্তা

প্রিয়নবী (সা.) হাদিসে বলেছেন যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করল সে মহান আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণের অন্তর্ভুক্ত হলো...।(মুসলিম, হাদিস : ১৩৭৯)

২) উত্তম দিনযাপন

ফজর নামাজ আদায়ের জাগতিক বহু উপকার রয়েছে। রাসুল (সা.) এক হাদিসে বলেন, তোমাদের কেউ ঘুমিয়ে পড়লে, শয়তান তার ঘাড়ের পেছনে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে সে এই কথা বলে, তোমার সামনে দীর্ঘ রাত অপেক্ষা করছে; অতএব তুমি শুয়ে থাকো। অতঃপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে একটি গিঁট খুলে যায়। অজু করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। অতঃপর নামাজ আদায় করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। তখন তার সকাল হয় উত্ফুল্ল চিত্তে ও প্রফুল্ল মনে। না হয়, সে সকালে কলুষ কালিমা ও আলস্য নিয়ে ওঠে। (বুখারি, হাদিস : ১১৪২)

৩) সবকিছুর চেয়ে উত্তম

আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ফজরের দুই রাকাত নামাজ দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে উত্তম। (মুসলিম, হাদিস : ১৫৭৩)

৪) অর্ধরাত ইবাদতের সওয়াব

মহানবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি জামাতের সঙ্গে এশার নামাজ আদায় করল, সে যেন অর্ধেক রাত পর্যন্ত (নফল) নামাজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করল, সে যেন সারা রাত জেগে নামাজ আদায় করল। (মুসলিম, হাদিস : ১৩৭৭)

৫) মুনাফিকির তালিকা থেকে বাদ

মহানবী (সা.) বলেন, মুনাফিকদের জন্য ফজর ও এশার নামাজের চেয়ে অধিক ভারী কোনো নামাজ নেই। এ দুই নামাজের ফজিলত যদি তারা জানত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও মসজিদে উপস্থিত হতো। (বুখারি, হাদিস : ৬৫৭)

৬) জাহান্নাম থেকে মুক্তি

রাসুল (সা.) হাদিসে বলেন, এমন কোনো ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে না, যে সূর্যোদয়ের ও সূর্যাস্তের আগের নামাজ আদায় করে। অর্থাৎ ফজর ও আসরের নামাজ। (মুসলিম, হাদিস : ১৩২২)

৭) পূর্ণ নুরের সুসংবাদ

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন 

রাতের অন্ধকারে মসজিদগুলোতে যাতায়াতকারীদের কিয়ামতের দিনের পরিপূর্ণ নুরের সুসংবাদ দাও।

(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৭৮১)

৮) ফেরেশতাদের সাক্ষাৎ

এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ফেরেশতারা পালাবদল করে করে তোমাদের মাঝে আসেন; একদল দিনে আসে, আরেক দল আসে রাতে। আসর ও ফজরের নামাজে উভয় দল একত্রিত হন। অতঃপর তোমাদের মাঝে রাত যাপনকারী দলটি আসমানে চলে যান। তখন আল্লাহ তাআলা তাদের জিজ্ঞেস করেন, আমার বান্দাদের কোন অবস্থায় রেখে এলে? অথচ তিনি তাদের ব্যাপারে সর্বাধিক অবগত। জবাবে তাঁরা বলেন, আমরা তাদের নামাজে রেখে এসেছি। আর আমরা যখন তাদের কাছে গিয়েছিলাম, তখনো তারা নামাজরত ছিলেন। (বুখারি, হাদিস : ৫৫৫)

৯) আল্লাহর সাক্ষাৎ

জারির বিন আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, একবার আমরা নবী করিম (সা.)-এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। তিনি রাতে (পূর্ণিমার) চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ওই চাঁদকে তোমরা যেমন দেখছ, ঠিক তেমনি অচিরেই তোমাদের প্রতিপালককে তোমরা দেখতে পাবে। তাঁকে দেখতে তোমরা কোনো ভিড়ের সম্মুখীন হবে না। কাজেই সূর্যোদয়ের আগের ও সূর্যাস্তের আগের নামাজ আদায় করতে পারলে তোমরা তা-ই করবে। (সুরা কাহফ, আয়াত : ৩৯)

১০) পরকালে শান্তি

জান্নাতে শান্তি একটি আলাদা সু-বাতাস চারপাশ্বে জরিয়ে থাকবে,যাতে সব কিছু ভাল লাগবে।

আল্লাহ নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়ার তাওফিক দান করুক।

 

 

 

 

 

 

Post a Comment

أحدث أقدم